বরগুনার মাঝেরচর। পুরো চর জুড়ে সবজির আবাদ। বরগুনা সদরের গুলিশাখালী এলাকার বিষখালি নদীর মাঝে এই চর। বর্ষা মৌসুমে চরে টমেটো, তরমুজ, ফুট, মরিচ, মুগডাল, কাঁকরোল, শসা, পানি কচুসহ নানান সবজির আবাদ করেছে কৃষকরা।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ভূমিহীন কিছু সংখ্যক জেলেরা ২০০৫ সাল থেকে মাঝেরচরে বসবাস শুরু করে। ২০০৭ সালের সিডরে মাঝেরচরের জেলেদের নড়বড়ে ঘরগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। এরপর জেলা প্রশাসন সেখানে আবাসন তৈরি করে দেয় মাঝেরচরের বাসিন্দাদের। এরপর থেকে শুরু হয় স্থায়ীভাবে বসবাস। মাঝেরচরে এখন চার শতাধিকের বেশি পরিবার বসবাস করছে।
কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, মাঝেরচরে পতিত জমিতে রেকর্ড পরিমাণ রবি শস্যের আবাদ হয়েছে এবার। জেলায় শীতকালীন সবজির ৪৮ ভাগ চাহিদা পূরণ করেছে মাঝেরচরের শস্য থেকে। কৃষি অফিসের সহায়তায় নদীতে মাছ শিকারের পাশাপাশি ১২ মাস সবজির আবাদ শুরু করেছে চরের বাসিন্দারা।
বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সকালে মাঝেরচর সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নতুন করে ২০০ হেক্টর জমিতে বর্ষা মৌসুমে টমেটো, তরমুজ, ফুট, মরিচ, খেসারী, কাঁকরোল, শসাসহ নানান সবজির আবাদ করেছে কৃষকরা। ক্ষেতে কাজ করছে নারীরাও। স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়ার ফাঁকে যোগ দিয়েছে চাষাবাদে।
কৃষক মো. খলিল ১১ একর জমিতে চাষ করেছেন নানান ধরনের সবজি। তার সঙ্গে সহায়তা করছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময় সাগরে মাছ ধরছিলেন তিনি। ওই সময় কোনমতে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন মাঝেরচরে। সাগর থেকে ফেরার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবার প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরলে আর কখনো সাগরে যাবেন না। ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা কাটার পরে মন বসান কৃষি কাজে। সময় পেলে মাঝের চরের আশপাশে জাল ফেলে মাছ শিকার করেন। কিন্তু সাগরে আর যান না। পরিবারের চাহিদা মেটাতে কৃষিকেই তিনি মূল পেশা হিসেবে বেছে নেন। শুরু করেন তরমুজের আবাদ, প্রথমবার আবাদেই সফল হন তিনি। মাত্র ৭৩ হাজার টাকা ব্যয় করে ২ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেন।
খলিল আরও বলেন, ‘এই টাকা থেকে অন্য কোথাও খরচ না করে পুরো টাকা দিয়ে কৃষির পরিধি বাড়াই। এরপর আর পিছু ফিরতে হয়নি আমাকে। ১১ একর জমিতে ১২ মাস সবজি আবাদ করি। এখন আমার দেখাদেখি পুরো মাঝেরচর শস্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। এখানকার প্রতিটি পরিবার এখন কৃষি পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। আমিও তাদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করি। কৃষি অফিস থেকে প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন কর্মকর্তারা আসেন আমাদের ক্ষেত পরিদর্শন করতে। আমাদের নানান পরামর্শ দিয়ে থাকেন তারা। এমনকি উন্নত মানের বীজ কৃষি অফিস কিনে আমাদের দিয়ে থাকে।’
খলিলের পাশের সবজি ক্ষেতের মালিক মাঝের চরের বাসিন্দা বারেক মিয়া। তিনিও পেয়েছেন সফলতা। বারেক মিয়া জানান, তার বন্ধু খলিলের ক্ষেতে প্রথম দিকে কাজ করতেন তিনি। কোনো টাকা পয়সার বিনিময় নয়, বন্ধুর ক্ষেতে বিনাপারিশ্রমিকে সহায়তা করতেন। মাঝে মাঝে বন্ধুর ক্ষেতের সবজি নিয়ে নিজেদের পরিবারের সবজির চাহিদা মেটাতেন। তিনিও পেশায় জেলে। সাড়ে তিন একর পতিত জমিতে এবার তিনি মুগডালের আবাদ করেছেন। প্রত্যাশার থেকেও বেশি ফলন এসেছে এর থেকে। এখন আর শুধু জেলে পেশায় নির্ভরশীল নন তিনি।
কৃষক সাগর জোমাদ্দার রাইজিংবিডিকে বলেন, দুই একর জমিতে পানি কচু, মিনা, ঢেঁড়স, শসা চাষ করেছেন। এখানে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য শ্রমিক। সকলে মিলে কাজ করেন। ছেলে বরগুনা সরকারি কলেজে লেখাপড়া করে। লেখাপড়ার ফাঁকে ফসলের মাঠে সময় দেয়।
বরগুনা জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মাঝেরচরে ১২ মাস সবজি আবাদ করে কৃষকরা। শীত মৌসুমে জেলার ৪৮ ভাগ সবজির চাহিদা পূরণ করেছে মাঝেরচরের কৃষকরা। এই চরে ২০০ হেক্টর জমিতে ফসলের আবাদ হয়েছে। মাঝেরচরে আসা-যাওয়া একটু কষ্টকর। তারপরও সেখানকার কৃষকদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, মাঝেরচরে আগামী বছর আরও বেশি শস্য আবাদের দিকে ঝুঁকবে সেখানকার বাসিন্দারা। ওই চরের মাটি খুবই উর্বর।